ধর্ষণের আলামত নষ্ট করেও স্বপদে বহাল ওসি।
বাড়িওয়ালার দশম শ্রেণি পড়ুয়া মেয়ের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে করেন ধর্ষণ! শুধু তাই-ই নয়, মুঠোফোনে ধারণ করে রাখেন আপত্তিকর ভিডিও। এরপর ভিডিও ছড়ানোর ভয় দেখিয়ে মেয়েটির সঙ্গে একাধিকবার হন ঘনিষ্ঠ। ঘটনাটি জানাজানির পর মামলা করেন ভুক্তভোগী মেয়েটির মা। অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তবে এখন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধেই উঠেছে ধর্ষণ মামলার আলামত ধ্বংসের অভিযোগ। ঘটনাটি বগুড়ার ধুনট উপজেলার। ধর্ষণ মামলার আসামির নাম মুরাদুজ্জামান। ৪৮ বছরের মুরাদুজ্জামান উপজেলার এলাঙ্গী ইউনিয়নের শৈলমারি গ্রামের মতিউর রহমানের ছেলে। তিনি জালশুকা হাবিবর রহমান ডিগ্রি কলেজের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ের প্রভাষক। ধর্ষণ মামলার আলামত ধ্বংস করার অভিযোগ উঠেছে ধুনট থানার ওসি কৃপা সিন্ধু বালার বিরুদ্ধে। এই অভিযোগ উঠার পর তদন্ত শুরু করেছে জেলা পুলিশ। তবে স্বপদে বহাল তবিয়তে থানায় ওসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন কৃপা সিন্ধু বালা। ওসি কৃপা সিন্ধু বালার বিরুদ্ধে মামলার আলামত নষ্টের অভিযোগ তুলেছেন ধর্ষণের শিকার ওই স্কুলছাত্রীর মা। এ বিষয়ে গত ২ আগস্ট তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বগুড়ার পুলিশ সুপারের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন। ধর্ষণের মামলার তদন্ত করছিলেন ওসি নিজেই। কিন্তু তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠার পর মামলার তদন্তের দায়িত্ব থেকে তাকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে ৩ আগস্ট ওসির বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) আব্দুর রশিদকে প্রধান করে মোট তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। আর ধর্ষণ মামলাটি জেলা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ওসির বিরুদ্ধে করা অভিযোগে বলা হয়েছে, তদন্তকারী কর্মকর্তা থাকাবস্থায় কৃপা সিন্ধু বালা ওই মামলার আসামি মুরাদুজ্জামানকে গ্রেপ্তার ও জিজ্ঞাসাবাদ করে তার কাছ থেকে দুটি মুঠোফোন উদ্ধার করেন। পরবর্তীতে মুঠোফোন দুটিতে থাকা আপত্তিকর ভিডিও সিডিতে কপি করেন। এসব সিডি ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) পাঠানোর কথা ছিল তার। কিন্তু ওসি কৃপা সিন্ধু বালা সিডিগুলো না পাঠিয়ে শুধু দুটি মুঠোফোন সিআইডিতে পাঠান। তবে এর আগে, দুটি মুঠোফোন থেকে আলামত ধ্বংস করেন তিনি। আলামত ধ্বংসের কাজে তাকে সহায়তা করেন বগুড়ার আদমদীঘি থানার উপপরিদর্শক (এসআই) প্রদীপ কুমার। তার কাছে মুঠোফোন দুটি পাঠিয়েছিলেন ওসি। অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে, ওসি কৃপা সিন্ধু বালা আসামি পক্ষের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা পেয়ে মামলার আলামত ধ্বংস করেছেন। আদমদীঘি থানার এসআই প্রদীপ কুমার বলেন, ‘ ওসি কৃপা সিন্ধু বালা আমাকে ফোন দিয়ে বলেন যে, মুঠোফোনে কিছু ভিডিও ছিল সেগুলো পাওয়া যাচ্ছে না। ওই ভিডিওগুলো পাওয়ার উপায় আমার কাছে জানতে চান তিনি। কিন্তু মুঠোফোন তিনি আমার কাছে পাঠাননি। এর বেশি কিছু আমার জানা নেই।’ জানতে চাইলে ওসি কৃপা সিন্ধু বালা বলেন, ‘মুরাদুজ্জামানের বিরুদ্ধে থানায় ধর্ষণ মামলা হয়। আমি তদন্ত করেছি। মুঠোফোন উদ্ধার করে ফরেনসিকে পাঠিয়েছি। ওই ধর্ষণ মামলাটি এখন ডিবি পুলিশ তদন্ত করছে।’ জানতে চাইলে ধর্ষণ মামলার আলামত ধ্বংসের বিষয়ে তিনি কিছু বলেননি। ধর্ষণ মামলার বাদী ও অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সাল থেকে ভুক্তভোগীদের বাড়িতে ভাড়া থাকছিলেন প্রভাষক মুরাদুজ্জামান। তার স্ত্রী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। এ কারণে সবসময় বাসায় থাকতেন না স্ত্রী। এ সুযোগে বাড়িওয়ালার মেয়ের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলেন মুকুল। পরবর্তীতে গত ৩ মার্চ বেলা ১১টার দিকে মেয়েটিকে নিজ ঘরে নিয়ে ধর্ষণ করেন তিনি। শুধু তাই নয়, ধর্ষণের কিছু আপত্তিকর দৃশ্যও মুঠোফোনে ধারণ করে রাখেন এ প্রভাষক। পরে আপত্তিকর ছবি ফেসবুকসহ বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে মেয়েটিকে সঙ্গে একাধিকবার ধর্ষণ করে। সর্বশেষ চলতি বছরের গত ১২ এপ্রিল সকালে ভাড়া বাসায় মেয়েটিকে ধর্ষণের চেষ্টা করেন মুরাদুজ্জামান। ওই সময় মেয়েটির চিৎকারে স্বজনরা এগিয়ে এলে কৌশলে বাসা থেকে পালিয়ে যান তিনি। পরে আর বাসায় ফেরেননি। তবে ওই ঘটনার পরপরই মুরাদুজ্জামানের পরিবারকে বাসা থেকে বের করে দেয় মেয়েটির পরিবার। পরবর্তীতে ১২ মে সকালে ধুনট থানায় মুরাদুজ্জমানের বিরুদ্ধে মামলা করেন ভুক্তভোগীর মা। মামলার পর ওইদিন সন্ধ্যায় মুরাদুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করা হয়। এছাড়াও মুরাদুজ্জামানের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ উঠার পর গত ২৪ মে ধুনটের জালশুকা হাবিবর রহমান ডিগ্রি কলেজ পরিচালনা কমিটি তাকে সাময়িক বহিস্কার করে। আদালতের রায়ে তিনি দোষী প্রমাণিত হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে তাকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হবে বলে সিদ্ধান্ত নেয় কলেজ পরিচালনা কমিটি। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আব্দুর রশিদ (অপরাধ) জানান, ওসির বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের তদন্ত চলছে। তবে কতদিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে হবে এরকম সময় বেধে দেওয়া হয়নি। ধর্ষণের আলামত নষ্টের অভিযোগ ওঠার পরেও তদন্তের স্বার্থে থানা থেকে ওসি কৃপা সিন্ধু বালাকে কেন সরিয়ে নেয়া হয়নি এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ আমার জানা মতে গতকাল (শনিবার) পর্যন্ত ধুনট থানায় অফিসার্স ইনচার্জ (ওসি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন কৃপা সিন্ধু বালা। রোববারের খবর আমার জানা নেই।’ রোববার বিকেলে ধুনট থানার অফিসার্স ইনচার্জের সরকারি নম্বরে যোগাযোগ করা হয়। ফোন রিসিভ করেন ওসি কৃপা সিন্ধু বালা। তিনি এখনো থানায় ওসির দায়িত্ব পালন করছেন। মামলার বাদি জানান যে, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ জানানোর পরও এই ওসি বহাল তবিয়তে থাকায় তারা নিরাপত্তা আতঙ্কে ভুগছেন ৷